
উপন্যাস সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য ও শ্রেণি বিভাগ
প্রসঙ্গ: উপন্যাসের সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য ও শ্রেণি বিভাগ।
‘উপন্যাস’ হচ্ছে আধুনিকতম এবং সমগ্রতাস্পশী সেই শিল্প-প্রতিমা, যেখানে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয় জীবনের আদি-অন্ত; শিল্পিত স্বরগ্রামে উদ্ভাসিত হয় লেখকের জীবনার্থ আর তাঁর স্বদেশ-সমাজ-সমকাল। আধুনিক যুগে সমাজ ও প্রকৃতির বিরুদ্ধে ব্যক্তি-মানুষের যে সংগ্রাম তারই-মহাকাব্যিক রূপ হলো উপন্যাস। এ প্রসঙ্গে সমালোচক Ralph Fox তাঁর বিখ্যাত The Novel and the People গ্রন্থে বলেন-
‘The novel is the epic-form of our modern , bourgeois society.’
‘উপন্যাস’ একটি সংস্কৃত শব্দ। সংস্কৃত মহাকবি কালিদাসের কাব্যে শব্দটির প্রথম প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। উপন্যাসের আক্ষরিক অর্থ ‘কল্পিত কাহিনী’। তবে আধুনিক পরিভাষায় উপন্যাস শব্দটি অনেকগুলো বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। তাই বলা যায় উপন্যাস মাত্রই কল্পিত কাহিনী, কিন্তু কল্পিত কাহিনী মাত্রই উপন্যাস নয়। বতর্মান যুগে ‘উপন্যাস’ কথাটির অর্থ ব্যাপক ও বিস্তৃত। সংস্কৃতে ‘উপন্যাস’ কথাটির ব্যুৎপত্তি এরকম উপ-নি-অস+অ (ঘঞ)=উপন্যাস। সুতরাং ব্যুৎপত্তিগত দিক থেকে উপন্যাসের অর্থ হলো ‘উপস্থাপন’। তাই এই দিক থেকে উপন্যাসের সংজ্ঞা দেয়া যায় এ ভাবে-‘বিশেষ নীতি ও নিয়মের মধ্যে নিদির্ষ্ট পরিকাঠামোয় যে কাহিনী বিস্তৃত হয় তাই ‘উপন্যাস’। তবে উপন্যাসের যথাযথ সংজ্ঞা দেয়া আদৌ সম্ভব নয়। কারণ, এর বিষয় ও উপস্থানগত বৈচিত্র্য। যদিও অনেক সাহিত্যতাত্ত্বিক উপন্যাসের সংজ্ঞা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তাই আমরা উপন্যাসের সংজ্ঞা নিণর্য়ের পাশাপাশি এর স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য নিরূপণের প্রয়াস পাব।
বাংলা ‘উপন্যাস’ শব্দটির ইংরেজি প্রতি শব্দ হলো Novel. ইংরেজি এই Novel এর সংজ্ঞা দেয় হয়েছে এ ভাবে-
‘a fictitious prose narrative or tale presenting a picture of a real life of the men and women portrayed.’
(Chamber’s Twentieth Century Dictionary &: Reader’s Digest Encyclopedia)
E. M. Forster উপন্যাসের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন-
‘Novel is prose narrative of sufficient length to fill one or two volumes.’
বাঙালি সমালোচক শ্রীশচন্দ্র দাস তাঁর ‘সাহিত্য সন্দর্শন’ গ্রন্থে উপন্যাসের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন-
‘গ্রন্থকারের ব্যক্তিগত জীবন-দর্শন ও জীবনানুভুতি কোন বাস্তব কাহিনীঅবলম্বন করিয়া যে বর্ণনাত্মক শিল্পকর্মে রূপায়িত হয়, তাহাকে উপন্যাস কহে।’
অন্য আরেক বাঙালি সমালোচক নারায়ণ চৌধুরী উপন্যাসের সংজ্ঞা দিয়েছেন এ ভাবে-
“উপন্যাস জীবনের একটা অখন্ড রূপায়ণ এবং সমগ্রতাই তার মর্মবস্তু।...একটা অর্থপূর্ণ অতীতের উৎস থেকে উদ্ভুত হয়ে যে জীবন দূর ভবিষ্যতে বিসর্জিত আর বর্তমান তার সাম্প্রতিক স্থিতিকাল।”
সুতরাং, উল্লিখিত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, ইংরেজি Novel বা বাংলা ‘উপন্যাস’ হল এক কল্পিত সুদীর্ঘ উপাখ্যান, গদ্যে বা পদ্যে লিপিবদ্ধ ও পাঠকের মনোরঞ্জনকারী জীবনের সমগ্রতাস্পর্শী এক সাহিত্য কর্ম বিশেষ।
অনেক সমালোচক উপন্যাসকে ‘পকেট থিয়েটার’ বলে অভিহিত করেছেন। কারণ, নাট্যকার রঙ্গমঞ্চ ও দৃশ্যবলীর সাহায্যে যে কাজ করেন, ঔপন্যাসিক বর্ণনার সাহায্যে সে কাজটি সম্পন্ন করেন। এর ঘটনাবলী কয়েকটি চরিত্রকে আশ্রয় করে গড়ে উঠে। অনেকে মনে করেন উপন্যাসে ঘটনাই মুখ্য, চরিত্র সৃষ্টি গৌণ। আবার কেউ কেউ মনে করেন, উপন্যাসে কয়েকটি বিশেষ চরিত্রকে ঘটনা সংঘাতের মাধ্যমে জীবন্ত করে তোলা হয়। তবে এ কথা সত্য যে ঘটনা ও চরিত্র সৃষ্টি পরস্পর নিরপেক্ষ নয়, বরং একটির সাথে অপরটি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। চরিত্রই মাকড়সার মতো নিজের চারিপাশে ঘটনার জাল বুনে ঘটনা প্রবাহ সৃষ্টি করে এবং এই ঘটনা প্রবাহই চরিত্র বিকাশে সহায়তা করে।
উল্লিখিত সংজ্ঞা থেকে আমরা উপন্যাসের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করতে পারি।
প্রথমত, উপন্যাস কল্পিত কাহিনী কিন্তু তা বাস্তব জীবনভিত্তিক।
দ্বিতীয়, উপন্যাসে লেখকের বাস্তব জীবনাভিজ্ঞতা রূপায়িত হবে।
তৃতীয়ত, উপন্যাসে মানব জীবনের অখণ্ড রূপায়ণ থাকবে এবং সমগ্রতাই এর মর্মবস্তু। চতুর্থত, উপন্যাস গদ্যে বা পদ্যে রচিত হবে।
বিভিন্ন মাপকাঠিতে উপন্যাসের বিচিত্র রকমের শ্রেণীকরণ করা যায়। মোটাদাগে উপন্যাসের শ্রেণীকরণ হলো নিম্নরূপ-
১) সামাজিক উপন্যাস: সমাজের রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক এবং বিভিন্ন রীতিনীতি নিয়ে যে উপন্যাস রচিত হয়, তাই সামাজিক উপন্যাস। বাংলা সামাজিক উপন্যাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বঙ্কিমের ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, ‘বিষবৃক্ষ; রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের’ বালি, ‘যোগাযোগ’; শরৎচন্দ্রের ‘গৃহদাহ’ ইত্যাদি।
২) ঐতিহাসিক উপন্যাস: অতীত ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনাবলী নিয়ে যে উপন্যাস রচিত হয়, তাকে ঐতিহাসিক উপন্যাস বলে। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ঐতিহাসিক উপন্যাস হলো-বঙ্কিমের ‘রাজসিংহ’; রমেশচন্দ্র দত্তের ‘রাজপুত জীবনসন্ধ্যা’; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রাজর্ষি’ ইত্যাদি।
৩) কাব্যধর্মী উপন্যাস: আখ্যান ও চরিত্র সৃষ্টি অপেক্ষা যে উপন্যাসে লেখকের কবিদৃষ্টি মুখ্য হয়ে উঠে এবং লেখকের স্নিগ্ধ-মধুর জীবনদৃষ্টি একটি বিশেষ কাব্যিক আবহে নির্মাণ করে, তাকে কাব্যধর্মী উপন্যাস বলে। বাংলায় কাব্যধর্মী উপন্যাস হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’ এবং রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’র কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
৪) ডিটেকটিভ উপন্যাস : যে উপন্যাসে খুন, হত্যা, গোয়েন্দা পুলিশের বিশেষ তৎপরতা আছে তাকে ডিটেকটিভ উপন্যাস বলে। বনফুলের ‘পঞ্চপর্ব’ এই জাতীয় উপন্যাস।
৫) বীরত্বব্যঞ্জক উপন্যাস : কোন বীরত্বব্যঞ্জক কাহিনী নিয়ে যে উপন্যাস রচিত হয় তাই বীরত্বব্যঞ্জক উপন্যাস। বাংলায় এই জাতীয় উপন্যাস নেই বললেই চলে।
৬) কাহিনী উপন্যাস : কোন গাথা, জনশ্রুতি বা লোক কাহিনী নিয়ে যে উপন্যাস রচিত হয়, তাকে কাহিনী উপন্যাস বলে। দীনেস সেনের ‘হরিদাসের গুপ্ত কথা’ এই জাতীয় উপন্যাস।
৭) লোকহর্ষক উপন্যাস : এই জাতীয় উপন্যাসে ভীতিপ্রদ পরিবেশ তৈরি করা হয়। বাংলায় এই শ্রেণীর উপন্যাস নেই বললেই চলে। তবে ইংরেজিতে এই শ্রেণীর উপন্যাস অনেক রচিত হয়েছে।
৮) পত্র-উপন্যাস : উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্রের পত্রের মাধ্যমে যখন কাহিনী ও ঘটনাবলীর বিস্তৃতি সাধন করা হয়, তখন তাকে পত্র-উপন্যাস বলা হয়। শৈলজানন্দের ‘ক্রৌঞ্চমিথুন’ এই জাতীয় উপন্যাস।
৯) আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস : যে উপন্যাসে পাত্র-পাত্রীগণ নিজেই নিজের কথা বলে এবং পাত্র-পাত্রীর কথার মাধ্যমেই কাহিনী ও ঘটনাবলীর বিস্তার ঘটানো হয়, সে উপন্যাসকে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস বলে। শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ বাংলায় অন্যতম আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস।
১০) হাস্য রসাত্মক উপন্যাস : যে উপন্যাসের কাহিনী বর্ণনার মধ্যদিয়ে লেখক হাস্যরসের সৃষ্টি করেন, সে জাতীয় উপন্যাসকে হাস্যরসাত্মক উপন্যাস বলে। কেদার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কোষ্ঠীর ফলাফল’ এই জাতীয় উপন্যাস।