
রুশোর সাধারণ ইচ্ছা মতবাদ
প্রশ্ন : রুশোর সাধারণ ইচ্ছা মতবাদটি আলোচনা কর।
অথবা, রুশোর সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্ব সমালোচনা সহকারে ব্যাখ্যা কর। অথবা, রুশোর সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্ব আলোচনা কর।
উত্তর: ভূমিকা: ফরাসি বিপ্লবের মহান নায়ক ও দার্শনিক জ্যাঁ জ্যাক রুশো ১৭২২ খ্রিস্টাব্দে জেনেভার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার প্রবক্তা, গণসার্বভৌম তত্ত্বের অকুন্ঠ সমর্থনকারী অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী । মহান এ দার্শনিক রচিত The Social Contract গ্রন্থখানি রাষ্ট্রচিন্তার এক অমূল্য সম্পদ। এ গ্রন্থে বর্ণিত সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্বটি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে রুশোর সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
১৯৬৬ সালের ছয় দফা সম্বন্ধে জানতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন:
১৯৬৬ সালের ছয়দফা আন্দোলন -OnlineRedingRoom (onlinereadingroombd.com)
কেউ কেউ রুশোর সাধারণ ইচ্ছাতত্ত্বকে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার মূর্ত প্রতীক এবং রাজনৈতিক দর্শণের চরম প্রকাশ বলে উল্লেখ করেছেন। আবার অনেকে একে কল্পিত রূপরেখা বলেও আখ্যায়িত করেছেন। তবে তার সাধারণ ইচ্ছা ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্যের দিশারি এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি।
সাধারণ ইচ্ছা কি: সাধারণ ইচ্ছার অর্থ জনগণের ইচ্ছা যা দ্বারা জনগণের কল্যাণ সাধিত হয়। মূলত রুশো সাধারণ ইচ্ছা বলতে জনগণের কল্যাণের কল্যাণকামী ইচ্ছাকে বুঝাতে চেয়েছেন। সকল প্রকৃত ইচ্ছার সমষ্টি হচ্ছে ‘সাধারণ ইচ্ছা’। অর্থাৎ সমাজের সামগ্রিক কল্যাণকামী ইচ্ছাই হচ্ছে‘ সাধারণ ইচ্ছা’। তবে রুশো দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বলেছেন যে,সকলের ইচ্ছাই সাধারণ ইচ্ছা নয়। শুধু সকলের প্রকৃত ইচ্ছা বা সমাজের সামগ্রিক কল্যাণকামী ইচ্ছাকেই সাধারণ ইচ্ছা বলা যেতে পারে।
সাধারণ ইচ্ছার উৎপত্তি: রুশো তার সুবিখ্যাত ÔSocial Contract’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে , চুক্তির মাধ্যমে সমাজ সৃষ্টির অব্যবহিত পরেই মানুষের ব্যক্তিগত ইচ্ছা সমগ্র সম্প্রদায়ের ইচ্ছায় পরিণত হয়। আর এ থেকে জন্ম নেয় সাধারণ ইচ্ছা
সাধারণ ইচ্ছার লক্ষ্য: জনগণের কল্যাণ এবং মঙ্গল সাধনই সাধারণ ইচ্ছার মূল লক্ষ্য। সাধারণ ইচ্ছাই সামাজিক ন্যায়বিচারের মাপাকঠি। রুশো বলেন, যা অন্যায় তা কখনই সাধারণ ইচ্ছা হতে পারে না।
সাধারণ ইচ্ছার প্রকারভেদঃ রুশোর মতে ,প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে দুটি ইচ্ছার সঞ্চার হতে পারে। যথাঃ (ক) ব্যক্তির যথার্থ ইচ্ছা এবং (খ) প্রকৃত ইচ্ছা।
(ক) ব্যক্তির যথার্থ ইচ্ছা ( Actual Will): ব্যক্তির যথার্থ ইচ্ছা হচ্ছে তার যুক্তি বিবজির্ত যা ব্যক্তিস্বার্থের উপর ভিক্তি করে প্রতিষ্ঠিত ।
(খ) ব্যক্তির প্রকৃত ইচ্ছা (Real Will): প্রকৃত ইচ্ছা ব্যক্তির বিবেকসম্পন্ন ইচ্ছা, অভিব্যক্তি। এ ইচ্ছা হচ্ছে ব্যক্তির যুক্তিযুক্ত ইচ্ছা এবং এটি সমাজের সাধারণ কল্যাণও মঙ্গল সাধনায় নিয়োজিত থাকে।
সাধারণ ইচ্ছার বৈশিষ্ট্য: সাধারণ ইচ্ছার কতিপয় বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায় । নিম্নে এগুলো আলোচনা করা হলঃ
১. অভ্রান্ত: রুশোর মতে ,সাধারণ ইচ্ছা অভ্রান্ত এবং সে হিসাবে তা সকল অধিকারে যথার্থ মানদন্ড হিসেবে কাজ করে।
২. সার্বভৌম: রুশোর মতে, সাধারণ ইচ্ছা কল্যাণকামী তাই একটি সার্বভৌম, এটি সীমাহীন ক্ষমতার অধিকারী।
৩. এটি অবিভাজ্য: রুশোর মতে, সাধারণ ইচ্ছা অবিভাজ্য। এটিকে বিভাজ্য করলে সামগ্রিক কল্যানের পরিবর্তে আংশিক কল্যাণ সাধিত হবে।
৪. ঐক্যের প্রতীক: রুশোর মতে, সাধারণ ইচ্ছা রাষ্ট্রীয় ঐক্যের প্রতীক। সাধারণ ইচ্ছাকে টিকিয়ে রাখতে হলে তাই রাষ্ট্রীয় সংগঠনের সংহতি বজায় রাখতে হবে।
৫. সকল ক্ষমতার উৎস : সাধারণ ইচ্ছা সকল ক্ষমতার উৎস। সরকার হচ্ছে এখানে সাধারণ ইচ্ছার ভৃত্য। এটি সাধারণ ইচ্ছার মতানুযায়ী কার্যকর থাকে।
৬. সাধারণ ইচ্ছা ভুল করে না : ব্যক্তি অনেক সময় নিজ স্বার্থে পরিচালিত হয় অথবা ভুল পথে যায়। এটি স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু বহু ব্যক্তির মিলনে যৌথভাবে সাধারণ ইচ্ছা প্রতিষ্ঠিত হলে তার মধ্যে ভুল ত্রুটি থাকা সম্ভব নয়।
তাছাড়া এটি গণমুক্তির সহায়ক, স্থায়ী এবং সবার ইচ্ছার প্রতিফলনে সমৃদ্ধ।
সমালোচনা: সাধারণ ইচ্ছাতত্ত্ব রুশোর রাষ্ট্রদর্শনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলেও এটি নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে। নিম্ন সমালোচনার বিভিন্ন দিক আলোচনা করা হলো:
১. অস্পষ্ট ন্যায়নীতির মানদণ্ড: রুশোর মতে, সাধারণ ইচ্ছা সামাজিক ন্যায় নীতির একমাত্র মানদণ্ড। তিনি বলেন, ন্যায়নীতি অনুসারে কর্ম সম্পাদনের অর্থ হচ্ছে সাধারণ ইচ্ছার অনুসরণ করা। কিন্তু সাধারণ ইচ্ছা কিভাবে ন্যায় নীতির মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহৃত হবে তা স্পষ্ট করা হয় নি।
২. অসামঞ্জস্যপূর্ণ: রুশো সাধারণ ইচ্ছাকে অপ্রতিনিধিত্বশীল বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু বর্তমানে সুষ্ঠু দলীয় ব্যবস্থা, সংবাদপত্র, বক্তৃতা মঞ্চ, বিভিন্ন সংঘ ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক পদ্ধতির উদ্ভবের ফলে আধুনিক প্রতিনিধিত্বশীল সরকার ব্যবস্থায় তার এ ধারণা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
৩. ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিপন্থী : রুশো বলেন, যদি কেউ সাধারণ ইচ্ছাকে মেনে চলতে অস্বীকার করে তবে তাকে বল প্রয়োগের মাধ্যমে তা মেনে চলতে বাধ্য করা হবে। কিন্তু এ কথা সর্বজনস্বীকৃত যে, রাষ্ট্র পরিচালনায় বল প্রয়োগ স্বাধীনতার চরম বিরোধী।
৪. আইনের অপপ্রয়োগ: রুশো সাধারণ ইচ্ছার সার্বভৌম কথা বলে মূলত আইনকে একটি নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে নিয়ে গেছেন।
৫. আপেক্ষিক মতবাদ: রুশো সকলের ইচ্ছার বা Will of All এবং সাধারণ ইচ্ছার বা General Will এর মধ্যে যে পার্থক্য নির্ধারণ করেছেন তা নিছক অর্থহীন ও বোকামি। কেননা মানুষর চিন্তা বা আকাঙ্খাকে আঙ্গিক নিয়মে যোগ বিয়োগ করে কোনো একটি বস্তুগত বিষয়ে উপস্থাপন করা যায় না।
তাছাড়া সাধারণ ইচ্ছা অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক নির্ধারণে অক্ষম, বাস্তবতা বিবর্জিত এবং একে সর্বাত্মকবাদী ধারণা বলে অনেকে মনে করেন।
উপসংহার: উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, উল্লিখিত সমালোচনা ও সমভেদসমূহ থাকা সত্ত্বেও জ্যাঁ, জ্যাক রুশোর ‘সাধারণ ইচ্ছাতত্ত্ব রাজনৈতিক দর্শনের ইতিহাসে যথেষ্ট মূল্য বহন করে। এটি ব্যক্তি স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের এক অপূর্ব সমন্বয়। গণতান্ত্রিক আদর্শের ধারণা, সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা ও জনগণের সার্বভৌমত্বের ধারণা রুশোর সাধারণ ইচ্ছাতত্ত্বে পাওয়া যায়। ফরাসি বিপ্লবের মূল স্লোগান রুশোর সাধারণ ইচ্ছারই বাস্তব রূপ। মোটকথা, আদর্শ হিসেবে রুশোর সাধারণ ইচ্ছাতত্ত্ব ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের দিশারি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থারই প্রতিচ্ছবি।
অগ্নিবীণা কাব্যের ঐতিহ্য চেতনা সম্বন্ধে জানতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন:
অগ্নিবীণা কাব্য অবলম্বনে নজরুলের ঐতিহ্য চেতনার স্বরূপ -OnlineRedingRoom (onlinereadingroombd.com)
অনলাইন রিডিং রুম শিক্ষক প্যানেল
+88 01713 211 910