
প্লেটোর শিক্ষাতত্তত্ত্ব, এ শিক্ষাব্যবস্থা আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কতটুকু প্রযোজ্য
প্রশ্ন: প্লেটোর শিক্ষাতত্তত্ত্ব আলোচনা কর। এ শিক্ষাব্যবস্থা আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কতটুকু প্রযোজ্য বলে মনে কর?
অথবা, “প্লেটোর রিপাবলিক শিক্ষার উপর রচিত সর্বোত্তম গ্রন্থ”- উক্তিটি ব্যাখ্যা কর। অথবা, প্লেটোর শিক্ষাব্যবস্থা সম্বন্ধে আলোচনা কর।
উত্তর: ভূমিকাঃ গ্রিক দার্শনিক মহাজ্ঞানী প্লেটো তার সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ The Republic’-এ ন্যায় ধর্মভিত্তিক আদর্শ রাষ্ট্র বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষার উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপন করেছেন। প্লেটোর মতে, শাসক ও যোদ্ধা শ্রেণীদের শাসন ও প্রতিরক্ষার কাজ সম্পাদনের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হলে একটি ব্যাপক ও সুষ্ঠু শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজন। কেবল শিক্ষার মাধ্যমেই তাদের চারিত্রিক গুণাবলির সম্যক পরিস্ফুটন ও রাষ্ট্রীয় ঐক্য বিধান সম্ভব। অধ্যাপক বার্কার প্লেটোর শিক্ষাব্যবস্থাকে সামাজিক ন্যায়ধর্ম ও সত্যানুসন্ধানের একটি সুষ্ঠু মাধ্যম বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, æ It is an attempt to cure a mental malady by mental medicine.
১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব সম্বন্ধে জানতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন:
১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব -OnlineRedingRoom (onlinereadingroombd.com)
প্লেটোর শিক্ষাতত্ত্ব : প্লেটো তার রিপাবলিক ’ গ্রন্থে শিক্ষা সম্পর্কে এত বিস্তারিত এবং এত গুরুত্বসহকারে আলোচনা করেছেন যে অনেক রিপাবলিককে মূলত একটি শিক্ষা সম্পর্কিত আলোচনা বলে উল্লেখ করেছেন। দার্শনিক রুশো বলেন, ÒThe Republic is the finest treasure on education that was ever written.” প্লেটোর শিক্ষাব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য ছিল ব্যক্তিকে পরিপূর্ণ সত্তায় বিকশিত করা এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে তার নির্ধারিত ভূমিকা পালনে উপযুক্ত করে গড়ে তোলা। তিনি বিশ্বাস করতেন রাষ্ট্রের নাগরিকগণ যদি শিক্ষিত হয় তবে তারা সহজেই সকল সমস্যার সমাধান করতে সচেষ্ট হবেন এবং সুদৃঢ়চিত্তে যেকোনো অবস্থার মোকাবিলা করতে সমর্থ হবেন। তবে শিক্ষাব্যবস্থাকে অবশ্যই রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ও বাধ্যতামূলক হতে হবে। কারণ শিক্ষা যদি বেসরকারি নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকে তবে তা গ্রহণ করা বা না করা ব্যক্তির একান্ত ইচ্ছাধীন ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু আদর্শ রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা ব্যক্তির ইচ্ছা হতে পারে না। তাই প্লেটো তার রাষ্ট্র দর্শন বাস্তবায়নে শিক্ষাব্যবস্থার উপর গুরুত্বরোপ করেছেন এবং অত্যন্ত খোলাখুলিভাবে বলেছেন, “রাষ্ট্র প্রথমত ও মূলত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।”
প্লেটোর শিক্ষা তত্ত্বের লক্ষ্য/উদ্দেশ্য: প্লেটোর শিক্ষাব্যবস্থার কতকগুলো লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ নর-নারীর শিক্ষা, শাসক শ্রেণির শিক্ষা, আদর্শ রাষ্ট্র বাস্তবায়নের শিক্ষা এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার শিক্ষা।
প্লেটোর শিক্ষার কারিকুলাম ও বিভিন্ন স্তর: প্লেটোর শিক্ষা পরিকল্পনা সম্পূর্ণরূপে সর্বাত্মক প্রকৃতির প্লেটো তার শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করেছেন। যথা- (ক) প্রাথমিক শিক্ষা ও (ক) উচ্চতর শিক্ষা। এ বিভাগ মূলত বয়সের ভিত্তিতে গঠিত হতো এবং বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন রকম শিক্ষা দান করা হয়।
(ক) প্রাথমিক শিক্ষাঃ প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার লক্ষ্য হবে শিশুর অন্তরে মহৎ ভাবমূর্তি সৃষ্টি করা। জন্মের পর হতেই প্রতিটি শিশু রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা গ্রহণ করবে। প্রাথমিক পর্যায়ে শাসক ও শাসিতের সন্তানগণকে একই প্রকার শিক্ষা লাভের সুযোগ দান করতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষা প্রধানত দুটি পর্যায়ে বিভক্ত থাকবে। যেমন- (ক) সংগীতমূলক (শৈশব-১৮ বছর) ও (খ) ব্যায়ামমূলক (১৯-২২ বছর)।
১. সংগীতমূলক শিক্ষা (শৈশব ১৮বছর): এ স্তরে শিক্ষার মধ্য দিয়ে শিক্ষাদাতাগণ শিশুর অপরিণত মানসিক বৃত্তিগুলো বিকশিত করে তুলতে সাহায্য করেন। এ পর্যায়ে হালকা ও সহজবোধ্য কবিতা, গল্প পাঠ, সংগীতচর্চা ও প্রাথমিক গণিতচর্চার মধ্য দিয়ে শিশুরা প্রাথমিক জ্ঞানার্জনের সুযোগ লাভ করবে। এ শিক্ষা কিশোরদের নিকট আনন্দময় করে তোলা উচিত। প্লেটোর মতে, জবরদস্তির জ্ঞান মনের কোনো উন্নতি বিধান করতে পারে না।
২. ব্যায়াম শিক্ষা (১৯-২২ বছর): এ পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীগণ শারীরিক ব্যায়াম বা দেহচর্চা ও সামরিক প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে আত্মসংযম, শৃঙ্খলাবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, পরিশ্রমী হওয়ার গুণাবলি অর্জন করতে সমর্থ হবে। এ সময়ে অন্য কোনো বিষয়ে অধ্যয়নের অবকাশ থাকবে না।
(খ) উচ্চতর শিক্ষা: এ শিক্ষাব্যবস্থা তিনটি স্তরে বিভক্ত যথা-
১. ২১ থেকে ৩০ বছর: এ স্তরে উচ্চতর গণিত, জ্যামিতি, জ্যোতিষশাস্ত্র এবং বাস্তব সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা দেওয়া হবে। এটিই এ পর্যায়ের শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য।
২. ৩০ থেকে ৩৫ বছর: পূর্বের পর্যায়েগুলো যারা সাফল্যের সাথে অতিক্রম করতে পারবে সেই কৃতি শিক্ষার্থীদের এ ৫ বছর একাগ্রভাবে উচ্চতর দর্শন, তর্কশাস্ত্র, অধিবিদ্যা অধ্যয়ন করতে হবে। এ সকল বিষয় অধ্যয়নের ফলে শিক্ষার্থীরা সকল জ্ঞানের মধ্যকার ঐক্যসূত্র কি তা জানার প্রয়াস পাবে।
৩. ৩৫ থেকে ৫০ বছর: এ পনের বছর পর্যন্ত তাদেরকে সরকারি কার্যে ও যুদ্ধ কার্যে প্রত্যক্ষভাবে অংশ্রগ্রহণ করে বাস্তব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে হবে। এ দীর্ঘ ৫০ বছরের জ্ঞান-সাধনা ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিক্ষার্থীগণ স্বাভাবিকভাবেই দার্শনিক শাসকোচিত গুণাবলি পূর্ণরূপে আয়ত্ত করতে সক্ষম হবে।
আধুনিককালে প্লেটোর শিক্ষাব্যবস্থার উপযোগিতা: বহু শতক পূর্বে প্লেটো তার শিক্ষাতত্ত¡ প্রদান করলেও আধুনিককালেও এর উপযোগিতা অস্বীকার করা যায় না। যেসব ক্ষেত্রে আধুনিককালেও প্লেটোর শিক্ষাব্যবস্থার উপযোগিতা লক্ষ করা যায়, সেগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলোঃ
১. বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা: প্লেটো যে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলেছেন তা আধুনিক বিশ্বের বহু রাষ্ট্রেই গ্রহণ করা হয়েছে।
২. উপযুক্ত নাগরিক গড়ে তোলা: প্লেটো শিক্ষার মাধ্যমে উপযুক্ত নাগরিক গড়ে তোলার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছিলেন। আজো পৃথিবীর সকল দেশেই শিক্ষার মাধ্যমেই উপযুক্ত নাগরিক গড়ে তোলার প্রয়াস চালানো হয়।
৩. শাসক ও সৈনিক শ্রেণীর প্রশিক্ষণ: প্লেটো শাসক ও সৈনিক শ্রেণীর জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ দানের কথা বলেছেন। আধুনিককালে প্লেটোর এ পরিকল্পনাকে বিভিন্ন রাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
৪. নারী শিক্ষা: আড়াই হাজার বছর পূর্বে প্লেটো নারী শিক্ষার প্রতি যে গুরুত্বরোপ করেছিলেন। তা বর্তমানকালেও প্রযোজ্য হচ্ছে। বর্তমান শতকে বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রই নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং বিভিন্ন দেশে নারীরা রাষ্ট্র পরিচালনাসহ বিভিন্ন গুরুদায়িত্ব পালন করছে।
সমালোচনা: প্লেটো শিক্ষাব্যবস্থা বা শিক্ষাতত্ত্ব সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। নিম্নের এর বিরুদ্ধে উত্থাপিত সমালোচনা প্রদত্ত হলোঃ
১. অগণতান্ত্রিকঃ প্লেটোর শিক্ষাব্যবস্থা ছিল গণতন্ত্রের পরিপন্থী। তিনি শুধু অভিভাবক শ্রেণীর চরিত্র গঠন করার জন্যই এ শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। কিন্তু রাষ্ট্রের একটি বৃহৎ অংশ উৎপাদক শ্রেণী বা শ্রমিক শ্রেণীকে এ থেকে বঞ্চিত করেছেন।
২. অঙ্কশাস্ত্রের উপর গুরুত্ব: প্লেটো তার শিক্ষাব্যবস্থায় অঙ্কশাস্ত্রের উপর অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু এককভাবে অঙ্কের উপর এতটা গুরুত্ব দেওয়া ঠিক নয়।
৩. ব্যয়বহুল ও দীর্ঘমেয়াদি: প্লেটোর শিক্ষাব্যবস্থা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও দীর্ঘমেয়াদি। জীবনের আনন্দ উল্লাস বাদ দিয়ে কেউ পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত শুধু জ্ঞান সাধনা করতে চায় না। বৃদ্ধ বয়সে শিক্ষা গ্রহণ পদ্ধতির কল্পনা করে তিনি মানুষের উৎসাহ নষ্ট করেছেন।
৪. কারিগরি ও বিজ্ঞান শিক্ষা অনুপস্থিতঃ প্লেটোর শিক্ষাব্যবস্থায় কারিগরি ও বিজ্ঞান শিক্ষার প্রয়োগ নেই। অথচ বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা একটি গতিশীল সমাজের পূর্ব শর্ত।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, বহু বছর পূর্বে প্লেটো যে সুন্দর ও সুনিয়ন্ত্রিত শিক্ষাব্যবস্থার উদ্ভাবন করেছিলেন কালের দাবিতে তা সমালোচিত হলেও শিক্ষাব্যবস্থার গুরুত্বকে আমরা একেবারে অস্বীকার করতে পারি না। শিক্ষা সম্পর্কে তার মতো মৌলিক গবেষণা এ যাবৎ আর কোনো চিন্তাবিদ করতে পারে নি। সর্বোপরি, তিনি যে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার কথা বলেছেন তা বর্তমানে সমাজতান্ত্রিক ও উদারনৈতিক উভয় দেশগুলোই চালু করেছে। তাইতো প্লেটোর শিক্ষাব্যবস্থা আজো একটি কালোত্তীর্ণ শিক্ষাসূচি হিসেবে পরিগণিত।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন সম্বন্ধে জানতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন:
১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনের পটভূমি -OnlineRedingRoom (onlinereadingroombd.com)
অনলাইন রিডিং রুম শিক্ষক প্যানেল
+88 01713 211 910