
১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনের পটভূমি
প্রশ্ন : ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনের পটভূমি বিচার কর। এর ফলাফল আলোচনা কর।
উত্তর : ভাষা আন্দোলন বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। ১৯৫২ সালে এই আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। তবে পাকিস্তান সৃষ্টির বহু পূর্বে এই আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিলো। মূলত ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে প্রস্তাবিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা কি হবে তা নিয়ে সুস্পষ্ট বিরোধ সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর তা ব্যাপক আকার ধারণ করে। যে পটভূমিতে ভাষা আন্দোলন সৃষ্টি হয় তাকে আমরা তিনটি শিরোনামে বিভক্ত করতে পারি। যেমন :
ক. পাকিস্তান পূর্ব ভাষা বিতর্ক :
খ. ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্ব (১৯৪৭-১৯৪৮) ও
গ. ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্ব (১৯৫২)
ক. পাকিস্তান পূর্ব ভাষা বিতর্ক : পাকিস্তান নাম অলীক রাষ্ট্রটি সৃষ্টি হওয়ার পূর্বেই এই রাষ্ট্রের ভাষা কি হবে এই নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। ১৯৩৭ সালে মুসলিমলীগের তৎকালীন সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে দলের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে প্রবর্তনের উদ্যোগ নেয়। বাঙালি নেতা এ কে ফজলুল হকের বিরোধিতার কারণে এই উদ্যোগ সফল হয় নি। পরবর্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বাহ্ণে প্রকৃতপক্ষে ভাষাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের উভয় অংশের নেতৃবৃন্দ ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি হয়। এ সময় ১৯৪৭ সালের ১৭ মে ‘মজলিসে ইত্তেহাদুল মুসলিমিন’এর উদ্যোগে হায়দারাবাদে অনুষ্ঠিত এক উর্দু সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে মুসলীম লীগের কেন্দ্রীয় নেতা চৌধুরী খালেকুজ্জামান ঘোষণা করেন উর্দু হবে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা। পরবর্তীতে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দীন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে মত দেন। এই দুই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশিষ্ট ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা’ শীর্ষক এক প্রবন্ধ লেখেনে। এই প্রবন্ধে শহীদুল্লা বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পিছনে জোরালো যুক্তি তুলে ধরেন। শহীদুল্লাহের এই প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার দাবি প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পায়।
টমাস হবসের সার্বভৌমত্ত্ব সম্বন্ধে জানতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন
টমাস হবসের সার্বভৌম তত্ত্ব -OnlineRedingRoom (onlinereadingroombd.com)
খ. ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্ব (১৯৪৭-১৯৪৮): পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার নানামুখি উদ্যোগ গ্রহণ করে। ফলে পূর্ব বাংলার জনগণ বিভিন্নভাবে এর প্রতিবাদ করে। বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার দাবি করে। আর এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন আনুষ্ঠানিক ভিত্তি পায়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ববঙ্গেও মানুষ স্বাভাবিকভাবেই উপলব্ধি করেছিল যে, পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলাই হবে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী ৫৬ শতাংশ মানুষের মুখের ভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে মাত্র ৩.৩ ভাগ মানুষের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার নানা ষড়যন্ত্র করতে থাকে। আর এর প্রতিবাদে পূর্ববঙ্গের মানুষ ফুঁসতে থাকে।
গ. ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্ব (১৯৫২) : রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১৯৫২ সাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বছর। এই বছরই ভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। ভাষার জন্য বাঙালির রক্তদানের মাধ্যমে রচিত হয় একুশে ফেব্রুয়ারি অমর ইতিহাস।
ভাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্ব শুরু হয় ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাস থেকে। জানুয়ারি মাসের ২৬ তারিখ এক সমাবেশে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এই ঘোষণায় ছাত্রসমাজ বিক্ষোভে ফেটে পরে। তারা প্রতিবাদ সমাবেশ কওে এবং ৩০ জানুয়ারি ঢাকা শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ধর্মঘট পালন করে। এরই ধারাবাহিকতায় ৪টা ফেব্রুয়ারি সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। এরপর ১১ ও ১৩ই ফেব্রুয়ারি পতাক দিবস পালিত হয়। এইভাবে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে সারা দেশে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই আন্দোলন দমানোর জন্য ২০ ফেব্রুয়ারি নূরুল আমিন ঢাকা শহরে সভাসমাবেশ নিষিদ্ধ করে এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। ছাত্রসমাজ ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং খণ্ড খণ্ড মিছিল বের করে। এতে পুলিশ নির্বিচারে গুলি করে। শহীদ হয় সালম বরকত রফিকসহ নাম নাজানা আরো অনেকে। এইভাবেই ভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতি পায়। ছাত্র হত্যার প্রতিক্রিয়া সমস্ত বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হয়। সমস্ত দেশ পাকশাসনের বিরুদ্ধে ফুসে ওঠে।
ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য:
ভাষা আন্দোলন একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন হলেও এর রাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ এবং স্বাধীকার আন্দোলনের ক্ষেত্রে ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কেননা, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার আন্দোলন ছিল না। এটি প্রাথমিকভাবে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জন্য পরিচালিত হলেও কালক্রমে তা রাজনৈতিক চরিত্র ও তাৎপর্য লাভ করে। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এদেশের আপামর জনসাধারণ রাজনৈতিক স্বাধিকারের ব্যাপাওে সচেতন হয়ে ওঠে। ভাষা আন্দোলন পরবর্তী আন্দোলন সংগ্রামের দৃঢ় মনোবল আত্মপ্রত্যয় সৃষ্টি করে। এ ছাড়া এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জিন্নাহ’র দ্বিজাতিতত্ত্বেও অসারতাও প্রকাশিত হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের সাথে বাঙালির যে ধর্মীয় বন্ধন ছাড়ার আর কোনো বন্ধন নেই তাও উন্মোচিত হয়।
ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন। এ আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলার জনগণের পক্ষে ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হয়। ভারত বিভাগের পর থেকে বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিমাতাসুলভ আচরণ পাকিস্তানের প্রতি এদেশের মানুষের মোহভঙ্গ ঘটে। প্রথমে এ আন্দোলন ছিল ভাষা ও সংস্কৃতির আন্দোলন। কিন্তু ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫২ সালের ঘটনাপ্রবাহ ভাষা আন্দোলনকে বাংলার মানুষের আর্থ সামাজিক রাজনৈতিক বিভিন্ন সমস্যার সাথে গ্রথিত করে ফেলে। সাধারণ মানুষ এর দ্বারা নিজেদের স্বতন্ত্র রাজনীতি, অর্থনীতি শিক্ষা ও সংস্কৃতি গড়ে তোলার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে থাকে। আর এরূপ উপলব্ধি মানুষের মনে স্বাধীনতার আকাক্সক্ষাকে তীব্রতর করে তোলে। তাই বলা যায় স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য ছিল অপরিসীম।
ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ সম্বন্ধে জানতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন:
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ -OnlineRedingRoom (onlinereadingroombd.com)
অনলাইন রিডিং রুম শিক্ষক প্যানেল
+88 01713 211 910