
টমাস হবসের সার্বভৌম তত্ত্ব
প্রশ্ন : টমাস হবসের সার্বভৌম তত্ত্ব আলোচনা কর এবং এর সীমাবদ্ধতা উল্লেখ কর।
অথবা ,হবসের সাবভৌম তত্ত্ব আলোচনা কর। অথবা, সমালোচনাসহ হবসের সার্বভৌম তত্ত্ব আলোচনা কর।
উত্তর: ভুমিকা: ইংরেজ দার্শনিক টমাস হব্সের সাবভৌম তত্ত্ব রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য অবদান সতের শতকের ইংল্যান্ডের বিরাজমান চরম রাজনৈতিক বিশৃঙ্খার পটভূমিতে টমাস হব্স তার বিখ্যাত গ্রন্থ ÔLeviathan’রচনা করেন। তৎকালীন ইংল্যান্ডের অরাজকতাপূর্ণ রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য তিনি তারগ্রন্থে চূড়ান্ত ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতাসম্পন্ন পরাক্রমশালী রাজার একচ্ছত্র কর্তৃত প্রতিষ্ঠার কথা বলেন এবং সৃষ্টি করেন তার সার্বভৌম তত্ত্ব।
আইনের সংজ্ঞা ও উৎস সম্বন্ধে জানতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন:
আইনের সংজ্ঞা দাও। আইনের উৎসসমূহ -OnlineRedingRoom (onlinereadingroombd.com)
হব্সের সার্বভৌম তত্ত্ব: হব্সের সার্বভৌম তত্ত্ব তার সামাজিক চুক্তি মতবাদেরই প্রত্যক্ষ ফসল। হব্সের মতে, রাষ্ট্রপূর্ব অবস্থায় মানুষ প্রকৃতির রাজ্যে বসবাস করতো। সেখানে কোনো শাসক, আইন-কানুন বা বিচার-সালিস কিছুই ছিল না। ফলে মানুষের জীবন ছিল নিঃসঙ্গ, কঠোর, নির্মম ও সংক্ষিপ্ত। প্রকৃতির রাজ্যের এরূপ অসহনীয় অবস্থার হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য প্রকৃতির রাজ্যের মানুষ নিজেদের মধ্যে চুক্তি সম্পাদন করে রাষ্ট্র সৃষ্টি করে এবং প্রত্যেকেই স্বেচ্ছায় নিজ নিজ অধিকার ও ক্ষমতা ব্যক্তি সংসদের নিকট সমর্পণ করে। এভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তি সংসদই অর্থাৎ শাসকই সার্বভৌম শক্তিতে পরিণত হয়। হব্সের মতে, সার্বভৌমত্বের দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে জন অসন্তোষ থেকে সমাজকে রক্ষা করা, জনগণের কল্যাণের জন্য উত্তম সরকারের নিশ্চয়তা বিধান করা, আইন তৈরি করা ও আইনের সঠিক ব্যাখ্যা দান করা। এমনকি জনগণের নিরাপত্তা বিধান করা, আইনের সমান ব্যবস্থার প্রচলন করা, প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সমআচরণ করা সার্বভৌম সরকারের কর্তব্য। ব্যক্তিমানুষের সেবা, স্বাধীনতা ও সম্পত্তি সংরক্ষণের দায়িত্বও এ সার্বভৌম সরকারের।
হব্সের সার্বভৌম তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য: হব্সের সার্বভৌম তত্ত¡টি বিশ্লেষণ করলে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো লক্ষ্য করা যায়ঃ
১. চুক্তির ফলে উদ্ভুত: প্রকৃতির রাজ্যের অসহনীয় অবস্থার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য জনগণ নিজেদের মধ্যে চুক্তি সম্পাদন করে সার্বভৌমিকতার জন্ম দিয়েছে।
২. সার্বভৌম শক্তি আইনের ঊর্ধ্বে: হব্সের মতে, সার্বভৌমের আদেশই আইন। সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ যেকোনো আইন প্রণয়ন ও বাতিল করতে পারেন। তিনি সব রকম নিয়ম-নীতি ও বিধি-বিধানের ঊর্ধ্বে থেকে শাসন কার্য পরিচালনা করেন। তার ক্ষমতার পরিধি রাষ্ট্রের মধ্যে সর্বত্র বিস্তৃত। কোনো আইন বা নিয়ম তাকে স্পর্শ করতে পারে না। তাই সার্বভৌম শক্তি সকল আইনের ঊর্ধ্বে অবস্থান করে।
৩. সার্বভৌম শক্তি সর্ব প্রকার নিয়ন্ত্রণমুক্ত: হব্সের সার্বভৌম শক্তি সর্বপ্রকার নিয়ন্ত্রণমুক্ত। তার ক্ষমতা অপ্রতিহত ও অপ্রতিরোধ্য। প্রাকৃতিক আইন. ঐশ্বরিক আইন, নৈতিক আইন, সামাজিক আইন প্রভৃতি কোনো আইনই তার ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
৪. সার্বভৌম ক্ষমতা চিরস্থায়ী: সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ স্বীয় ক্ষমতা কারো নিকট হস্তান্তর করে না এবং কারো নিকট দায়ী থাকে না। এর অপসারণ বা বিরোধিতা করা যায় না কাজেই এটি চিরস্থায়ী।
৫. সার্বভৌম শক্তি শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতীক: সার্বভৌম ক্ষমতা রাষ্ট্র ও জনগণের সমুদয় শান্তি নিরাপত্তা বিধান করবে। হব্সের মতে, মানুষ সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের নিকট হতে শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করে বলেই এ ধরনের চুক্তির ভিত্তিতে তাদের সকল ক্ষমতা সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের নিকট অর্পণ করেছে।
৬. সার্বভৌম শক্তি চুক্তিভঙ্গ করতে পারে না: জনগণ যেহেতু নিজেদের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে তাদের নিজ নিজ ক্ষমতা ও অধিকার সার্বভৌমের নিকট শর্তহীনভাবে অর্পণ করেছে এবং সার্বভৌম শক্তি যেহেতু চুক্তির কোনো পক্ষ নয়, সেহেতু সার্বভৌম শক্তি চুক্তি ভঙ্গ করতে পারে না। অর্থাৎ তার বিরুদ্ধে চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগ উত্থাপন করা যাবে না।
৭. সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী: হব্সের মতে, চুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সার্বভৌম সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী। রাষ্ট্রের সার্বভৌম শক্তির সমকক্ষ অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ থাকতে পারে না। সার্বভৌম শক্তিকে অন্য কোনো ঊর্ধ্বতন অথবা অধস্তন কর্তৃপক্ষ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
৮. সশস্ত্র বাহিনী নিয়ন্ত্রণ: প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তি স্থাপন কিংবা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার জন্য সার্বভৌম ক্ষমতা রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করে।
সমালোচনা: হব্সের সার্বভৌম তত্ত্বটি বিভিন্নভাবে সমালোচিত হয়েছে। নিম্নে উল্লেখযোগ্য সমালোচনাগুলো ব্যাখ্যা করা হলোঃ
১. অবাস্তব: হব্সের সার্বভৌম ক্ষমতাকে সমালোকগণ অবাস্তব বলে চিহ্নিত করেছেন। কেননা এরূপ চরম ও নিরুঙ্কুশ ক্ষমতা প্রয়োগ করা কোনো শাসকের পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া আধুনিক সার্বভৌমত্বের ধারণার সাথে এটি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কাজেই এটি অবাস্তব।
২. অগণতান্ত্রিক: হব্সের সার্বভৌম তত্ত্বে শাসকের অত্যাচার ও উৎপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা বিদ্রোহ করার অধিকার জনগণকে দেওয়া হয় নি। সুতরাং হব্সের সার্বভৌম তত্ত্ব ছিল অগণতান্ত্রিক।
৩. একতরফা চুক্তি: হব্সের সার্বভৌম চুক্তিতে রাজা কোনোভাবেই অংশগ্রহণ করেন না। ফলে এটি একতরফা চুক্তিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে চুক্তি সব সময় দ্বিপাক্ষিক অথবা বহুপাক্ষিক হয়ে থাকে।
৪. স্বৈরাচারের নামান্তর: হব্সের সার্বভৌম তত্ত্ব শাসককে স্বৈরাচারী হতে সহায়তা করে। কেননা সার্বভৌম শাসকের অত্যাচারে ও উৎপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা বিদ্রোহ করার অধিকার জনগণকে দেওয়া হয় নি।
৫. দাসত্বের দলিল: হব্স যে সার্বভৌমিকতার তত্ত্ব প্রদান করেছেন তা দাসত্বের দলিল ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ তার তত্ত্বে জনগণের কোনো অধিকার স্বীকৃত হয় নি।
তাছাড়া হবসের সার্বভৌমত্ব তত্ত্বকে অনেকে অবমাননাকর, স্বার্থবাদী, জনগণের ক্ষমতা অস্বীকারের ধারক ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিপন্থি বলে মন্তব্য করেছেন।
উপসংহার: উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আধুনিক রাজনৈতিক চিন্তাধারাকে বিকশিত করতে তার মতবাদ যথেষ্ট সাহায্য করেছে। তিনি স্বৈরতন্ত্রকে স্বীকার করলেও জনস্বার্থকে অধিক গুরুত্ব প্রদান করেছেন। কেননা ইংল্যান্ডের তৎকালীন বিরাজমান অবস্থা মোকাবিলা করার জন্য তার তত্ত্ব বিশেষভাবে উপযোগী ছিল। তাছাড়া হব্স সার্বভৌম শক্তিকে দিয়ে অবশ্যই আইন-শৃঙ্খলা ও প্রজাগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চেয়েছেন এটি তার গণতান্ত্রিক মনেরই পরিচয় বহন করে।
প্লেটোর শিক্ষাতত্ত্ব সম্বন্ধে জানতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন:
অনলাইন রিডিং রুম শিক্ষক প্যানেল
+88 01713 211 910