
আইনের সংজ্ঞা দাও। আইনের উৎসসমূহ
প্রশ্ন : আইনের সংজ্ঞা দাও। আইনের উৎসসমূহ আলোচনা কর। আইন কি স্বাধীনতার পরিপন্থী?
উত্তর: ভূমিকাঃ আইন সমাজের দর্পণস্বরূপ। সমাজজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা আইনের প্রভাব লক্ষ করি। প্রাকৃতিক জীবন যেমন নিয়মের দ্বারা নিরবচ্ছিন্নরূপে পরিচালিত হয়, সমাজও তেমনিভাবে নানাবিধ নিয়মের দ্বারা পরিচালিত হয়। আর নিয়ম- শৃঙ্খলার মধ্য দিয়েই আমাদের জীবনে পথে চলতে হয়। সাধারণত এসব নিয়মসমূহই আইন।
আইনের ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে Law এ Law শব্দটি টিউটনিক Lag শব্দ থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। শব্দের অর্থ হচ্ছে স্থির বা অপরিবর্তনীয়। সুতরাং উৎপত্তিগত অর্থে আইন হচ্ছে কতিপয় নির্দিষ্ট অপরিবর্তনীয় বিধি বিধানের সমষ্টি।
সাধারণ অর্থে আইন বলতে রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত এমন কতকগুলো নিয়ম-কানুন বা বিধিকে বুঝায় যে সকল বিধি-বিধান মানুষের বাহ্যিক আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং যা ভঙ্গ করলে শাস্তি পেতে হয়।
বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও আইনবিদ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আইনের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তাদের দেওয়া কতিপয় উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা তুলে ধরা হলো:
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সম্বন্ধে জানতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন:
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা -OnlineRedingRoom (onlinereadingroombd.com)
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক এরিস্টটল (Aristotle) এর মতে, পক্ষপাতহীন যুক্তিই হচ্ছে আইন । ( Law is the passionless reason.)
টি. এইচ. গ্রিন ( T.H.Green) মনে করেন, জনগণের যে অধিকার ও কর্তব্যসমূহ রাষ্ট্রের কর্তৃত্বাধীনে রক্ষিত ও সম্পাদিত হয়ে থাকে তাকেই আইন বলে।
জন অস্টিন এর মতে, “আইন হলো সার্বভৌমের নির্দেশ।” (law is the command of the sovereign)
মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন এর মতে, “আইন হচ্ছে স্থায়ী আচার- ব্যবহার ও চিন্তাধারার সেই অংশ যা সাধারণ নিয়মাবলি হিসেবে সুস্পষ্ট এবং আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করেছে এবং যার পিছনে সরকারের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা বর্তমান।”
মার্কসবাদীদের মতে, সমাজের প্রতিপত্তিশালী শ্রেণীর স্বার্থবাহী নিয়ম-কানুনই হলো আইন।
সুতরাং উপরিউক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায়, আইন হলো মানুষের জন্য বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রকারী এমন কতকগুলো নিয়ম-কানুন যা রাষ্ট্রীয় সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত ও কার্যকরী হয়ে থাকে।
আইনের উৎসসমূহ: ঐতিহাসিক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আইনের নানা উৎস পাওয়া যায়। নিম্নে আইনের উৎসমূহ আলোচনা করা হলোঃ
১. প্রথা: প্রাচীন যুগে প্রথাই ছিল তৎকালীন বিধি-নিষেধের প্রধান উৎস। সাধারণভাবে প্রথা বলতে বহুদিন ধরে সমাজে প্রচলিত লোকাচারকে বুঝায়। টি. ই. হল্যান্ড (T.E.Holland) এর মতানুসারে কোনো এক সময়ে কোনো ব্যক্তি কোনো উদ্দেশ্য বা আকস্মিকভাবে বিশেষ রীতিনীতি সমাজে প্রবর্তন করে। কালক্রমে অন্য সকলে তা মেনে চলে। এভাবেই প্রথার উদ্ভব হয় যা আইনের অন্যতম উৎস।
২. ধর্ম: আদিম ও প্রাচীন সমাজের বিবর্তনের ধর্মসংস্কার একটি প্রধান স্থান অধিকার করেছিল। আদিম যুগে অসভ্য মানুষের উদ্ভুত আচরণের উপর ধর্মীয় অনুশাসনগুলো ছিল একমাত্র নিয়ন্ত্রক। প্রাচীন গ্রিসে ও রোমে অধিকাংশ আইন ছিল ধর্মভিত্তিক। মিসরে আইনের উপর ধর্মের প্রভাব ছিল প্রবল।
৩. বিচারকের রায়: সর্বোচ্চ আদালতের বিচার মীমাংসা বা রায় অনেক সময় আইনের উৎস হিসেবে কাজ করে। আদিম সমাজে ধর্ম ও প্রথার উপর ভিত্তি করে বিবাদ - বিসংবাদ মিটিয়ে ফেলা হতো। কিন্তু সমাজজীবন ক্রমগতিতে জটিল হেয় পড়ায় ধর্ম ও প্রথার স্থান দখল করেছে বিচারব্যবস্থা।
৪. বিজ্ঞানসম্মত আলোচনাঃ বিশিষ্ট আইনবিদদের বিজ্ঞানসম্মত পর্যালোচনাও আইনের আর একটি উৎস। ব্রিটেনের কোক (Coke) ও ব্লাকস্টোন ((Blackstone) যুক্তরাষ্ট্রের স্টোরি, কেণ্ট প্রমুখ ন্যায়শাস্ত্রীগণ আইনের বৈজ্ঞানিক আলোচনার মধ্য দিয়ে আইনকে সমৃদ্ধ করেছেন।
৫. আইন প্রণয়ন: আইনসভা হচ্ছে আইনের একটি আধুনিক উৎস। অন্যান্য উৎসের চেয়ে এ উৎসের কার্যকারিতা ও গুরুত্ব বেশি। বর্তমান গণতান্ত্রিক প্রেক্ষাপটে আইন পরিষদ হচ্ছে আইনের প্রধান উৎস। আইন পরিষদ হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান।
৬. জনমত: আইনের উৎস হিসেবে জনমত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আইনসভার সদস্যগণ জনগণের প্রতিনিধি জনমতের বাস্তব প্রতিফলন ঘটানো তাদের অন্যতম দায়িত্ব।
৭. সংবিধান: সংবিধান আইনের একটি বৃহৎ উৎস। আইনসভা ও অন্যান্য সরকারি বিভাগের ক্ষমতা সীমিত করা এবং এদের কার্যরীতি প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কোনো ঊর্ধ্বতন আইন প্রণয়ন বাঞ্ছনীয় বলে অনুভব করা হয়। এর তাগিদেই অনেক রাষ্ট্রে সংবিধান তৈরি করা হয়।
৮. বৈদেশিক চুক্তি: সাধারণভাবে বৈদেশিক চুক্তি হওয়ার পর তা আইনে পরিণত হয়। এরূপ চুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষমতা সাধারণত নির্বাহী বিভাগের হাতে ন্যস্ত থাকে।
৯. নির্বাহী ঘোষণা ও ডিক্রি : আধুনিককালে শাসনব্যবস্থায় জটিলতার কারণে আইসভা তার কর্তৃত্ব নির্বাহী বিভাগীয় কর্মকর্তাদের নিকট অর্পণ করে। এরূপ ক্ষমতাবলে জারিকৃত ঘোষণা ও আদেশগুলোকে ডিক্রি আইন বা প্রশাসনিক আইন বলে।
আইন স্বাধীনতার পরিপন্থী কিনা: আইন ও স্বাধীনতা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ব্যবহৃত দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয়। রাষ্ট্রে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে বসবাসের জন্য উভয়েরই প্রয়োজন রয়েছে। তবে আইনকে কেই কেউ স্বাধীনতার পরিপন্থী বলে মনে করলের তাদের এ ধারণা অমূলক। কেননা জনগণের স্বাধীনতা সংরক্ষণই আইনের মূল লক্ষ্য। তদুপরি আইন যদি জনগণের মতামতের ভিত্তিতে প্রণীত হয়, তাহলে আইন কখনো স্বাধীনতার পরিপন্থী হতে পারে না; বরং তা স্বাধীনতা রক্ষায় সহায়ক। এ সম্পর্কে জ্যাঁ জ্যাক রুশো বলেন, “স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য আইন প্রয়োজনীয় অধিকার সকলের মধ্যে বণ্টন করে দেয়।
উপসংহার: উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আইন স্বাধীনতার সংরক্ষক, প্রতিবদ্ধক নয়। স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করতে হলে তাই আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে স্বাধীনতা লঙ্ঘিত হবে। তবে প্রত্যেক ব্যক্তির নিজস্ব কাজ-কর্ম চলাফেরা, অধিকার রক্ষা তা অবশ্যই আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। তা না হলে স্বাধীনতাকে রক্ষা করা যাবে না। যদিও এমন কতকগুলো আইন রয়েছে যা স্বাধীনতার পক্ষে ভীতিস্বরূপ বা স্বাধীনতাকে খর্ব করে, তথাপি জনমতের দ্বারা সৃষ্ট আইন যদি সুস্পষ্টভাবে প্রয়োগ করা হয়, তবে তা স্বাধীনতাকে খর্ব করে না বরং স্বাধীনতা রক্ষা করে। তাইবলা যায় যে, আইন স্বাধীনতার সংরক্ষক কিন্তু পরিপন্থী নয়।
১৯৫৪ সালের নির্বাচন সম্বন্ধে জানতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন:
১৯৫৪ সালের নির্বাচন -OnlineRedingRoom (onlinereadingroombd.com)
অনলাইন রিডিং রুম শিক্ষক প্যানেল
+88 01713 211 910