
১৯৫৪ সালের নির্বাচন
প্রশ্ন : ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিশ্লেষণ কর।
উত্তর: ১৯৫৪ সালের নির্বাচন পাকিস্তানের রাজনীতিতে গভীরতর ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। পূর্ববাংলা তথা বাংলাদেশকে স্বৈরাচারি মুসলিমলীগের দুঃশাসন থেকে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শোষণের হাত থেকে রক্ষার ক্ষেত্রে এই নির্বাচনের তাৎপর্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। কেন্দ্রিয় মুসলিম সরকারে হীন ষড়যন্ত্রের কারণে যুক্তফ্রন্ট সরকার বেশি দিন টিকে থাকতে না পারলেও এ নির্বাচনের ফলে পাকিস্তানের নতুন গণপরিষদে পূর্ববাংলার প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব সুনিশ্চিত হয়। ১৯৫৬ সালের সংবিধান প্রণয়ন এবং পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রেও ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। ফলে এটি শুধু ভোটের লড়াই ছিল না। এটি পাকিস্তানের সংসদীয় ইতিহাসে এক নব অধ্যায়ের সূচনা করে। ঐতিহাসিকগণ ১৯৫৪ সালের নির্বাচনকে মুসলিম লীগের প্রতি পূর্ববাংলা মানুষের ‘ব্যালট বিপ্লব’ বলে অভিহিত করেছেন। নিম্নে এই নির্বাচনের গুরুত্ব সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হলো:
প্লেটোর শিক্ষাতত্তত্ত্ব, এ শিক্ষাব্যবস্থা সম্বন্ধে জানতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন:
১. বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিজয়: ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের বিজয় প্রকৃতপক্ষে বাঙালি জাতীয়তাবাদেরই বিজয়। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে যে জাতীতায়তাবাদের সৃষ্টি হয় এই নির্বাচনে তা বাস্তব ভিত্তি পায়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পরে ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদ আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়। এই জাতীয়তাবাদী চেতনাই পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
২. স্বায়ত্তশাসনের দাবির যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠিত: ১৯৫৪ সালে নির্বাচনের পূর্বে যুক্তফ্রন্ট ২১ দফা নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করে। এই ২১ দফার অন্যতম দাবি ছিল আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন। নির্বাচনের বিজয়ের মাধ্যমে এই দাবি যৌক্তিক ভিত্তিপায় এবং আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়। পরবর্তী কালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয়দফার মাধ্যমে এই দাবি আরো জোরালো হয়।
৩. বিরোধী দলের উদ্ভব : দেশ বিভাগের পর পাকিস্তানে প্রকৃত পক্ষে কোনো বিরোধী দল ছিলো না। সেখানে ছিল মুসলিম লীগের একচ্ছত্র আধিপত্য। কিন্তু ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের রাজনীতিতে কার্যকর বিরোধী দলের উদ্ভব হয়। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পূর্বে ব্যাপকভাবে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা যাচাই সম্ভব হয় নি। অন্যদিকে ১৯৫৩ সালে এ কে ফজলুল হক কৃষক শ্রমিক পার্টি গঠন করেন এবং হাজী দানেশ গণতন্ত্রী পার্টি গঠন করেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে এই সমস্ত দল এক্যবদ্ধ হয় এবং কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।
৪. বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি : এক রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি অর্জিত হয়। কিন্তু পাকিস্তান সরকার এই দাবীকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় নি। এ কারণে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের ২১ দফা ইশতেহারের অন্যতম ঘোষণা ছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা কর। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ব্যাপক বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি আরো দৃঢ় ভিত্তি পায়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পরবর্তীতে গঠিত গণপরিষদে উর্দু ভাষার পাশাপাশি বাংলাকেও গণপরিষদের ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।
৫. মুসলিম লীগের পতন: মুসলিম লীগের পতনই ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের অন্যতম তাৎপর্য। এই নির্বাচনের মুসলিম লীগের ব্যাপক ভরাডুভি হয়। মূলত এ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে মুসলিম লীগের কার্যকর পতন শুরু হয়। ১৯৫৪ সালের পর থেকে সমগ্র পাকিস্তানে মুসলিম লীগ আর কখনও গ্রহণযোগ্যতা লাভ করতে পারে নি। ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের পর এই দলটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
৬. সাম্প্রদাকিতার পরিবর্তে অসম্প্রদায়িক রাজনীতির বিকাশ: ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ব বাংলায় যে অসম্প্রদায়িক চেতনার উত্থান ঘটে, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে তা প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পায়। সাম্প্রদাকি রাজনীতির ধারক মুসলিম লীগ এই নির্বাচনে সর্বাংশে পরাজিত হয়। যুক্তফ্রন্টের মাধ্যমে বিভিন্ন মতাদর্শের প্রগতিবাদী ও মানবতাবাদী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হতে সক্ষম হয়। আর এর মধ্য দিয়ে সাম্প্রদাকিতার পরিবর্তে অসম্প্রদায়িক রাজনীতির বিকাশ সূচিত হয়। আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৯৫৫ সালে সাম্প্রদায়িক শব্দ ‘মুসলিম’ বাদ দিয়ে শুধু ‘আওয়ামী লীগ’এ রূপান্তরিত হয়।
৭. যোগ্যনেতার আবির্ভাব: ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যোগ্য নেতা ও নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে। এ সময় মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানি, হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদী, শেরে বাংলা এ কে ফুজলুল হক ছাড়াও অনেক তরুণ নেতৃত্বের জাগরণ ঘটে। এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর আবির্ভাব উপমহাদেশের রাজনীতিতে বিশেষভাবে তাৎপর্যবহ। পরবর্তীকালে এই বঙ্গবন্ধুই বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেন।
৮. সচেতন রাজনৈতিক বোধের বিকাশ: পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ববাংলার প্রথম নির্বাচন ছিল ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচন। এ নির্বাচনের মাধ্যমে পূর্ববাংলার জনগণ স্বীয় দাবিদাওয়া উত্থানপূর্বক মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতয় অবতীর্ণ হয়। এ নির্বাচনে জনগণের বিজয় সুনিশ্চিত হয়। এতে জনগণের মধ্যে যে আগ্রহের সৃষ্টি হয় তাই কালক্রমে এ অঞ্চলে সচেতন রাজনৈতিক বোধের বিকাশ ঘটে।
বস্তুত, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এ নির্বাচনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে পূর্ববাংলার জনগণের বিরূপ মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ঐতিহাসিক ২১ দফার ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে অবতীর্ণ হয়। এই ২১ দফা ছিল পূর্ববাংলার জনগণের প্রাণের দাবি। এই দাবিকে কেন্দ্র করেই তারা ঐক্যবদ্ধ হয় এবং এই ঐক্যবদ্ধ জাতীয়তাবাদী চেতনাই ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে ত্বরান্বিত করে।
এরিস্টটলের মতে বিপ্লবের কারণ কি? বিপ্লব প্রতিরোধের জন্য তিনি কী কী প্রতিবিধান সুপারিশ করেছেন? সম্বন্ধে জানতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন:
অনলাইন রিডিং রুম শিক্ষক প্যানেল
+88 01713 211 910