
রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত সামাজিক চুক্তি মতবাদ
প্রশ্ন: রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত সামাজিক চুক্তি মতবাদ আলোচনা কর।
অথবা, সমালোচনাসহ রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত সামাজিক চুক্তি মতবাদটি ব্যাখ্যা কর।
অথবা, রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে সামাজিক চুক্তি মতবাদ সমালোচনাসহ আলোচনা কর।
ভূমিকাঃ রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত মতবাদগুলোর মধ্যে সামাজিক চুক্তি মতবাদটি অন্যতম। এ মতবাদটি কেবল রাষ্ট্রের উৎপত্তিই ব্যাখ্যা করে না, শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক নির্ধারনে ও বিশেষ সাহায্য করে। প্লেটো এবং এরিস্টটলের লেখনীতেও এ চুক্তিবাদের কথা উল্লেখ আছে।
সামাজিক চুক্তি মতবাদ কী ? : সামাজিক চুক্তি মতবাদের মূলকথা হলো- রাষ্ট্র বিধাতা কৃর্তক সৃষ্টি হয় নি বরং তা সমাজবদ্ধ মানুষের সৃশৃঙ্খল ও সুসংহত প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করার পর এক ধরনের চুক্তির ফলেই উদ্ভুত হয়েছে। রাজনৈতিক সংগঠনের পূর্বে যখন জনসমাজে প্রাকৃতিক নিয়ম- কানুন প্রচলিত ছিল এবং মানবিক কোনো আইন- শৃঙ্খলায় সামাজিক জীবন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে নি, তখন জনসাধারণবিভিন্ন সমস্যায় পতিত হয়ে রাষ্ট্রীয় সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে এবং নিজেদের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের জন্মদান করে।
হব্সের মতবাদ: টমাস হবসের সামাজিক চুক্তি মতবাদ ১৬৫১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত তার ‘লেভিয়াথান’ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। ব্রিটিশ এ চিন্তানায়কের মতে, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন শুরু হওয়ার আগে মানুষ যে অবস্থায় বসবাস করতো এবং প্রাকৃতিক নিয়ম দ্বারা পরিচালিত হতো সে অবস্থাকে প্রাকৃতিক অবস্থা বলে। এ প্রাকৃত অবস্থায় মানুষ ছিল হিংস্র ও স্বার্থপর। এ অবস্থায় কোন আইন ছিল না। কাজেই প্রকৃতির রাজ্যে মানুষের জীবন ছিল অসহায়, বিশৃঙ্খল, দরিদ্র, পাশবিক এবং স্বল্পায়ু। প্রকৃতির রাজ্যে এ ভয়াবহ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ লাভের আশায় তারা চুক্তিবদ্ধ হয়। হবসের মতে, এ চুক্তিই হচ্ছে সামাজিক চুক্তি। পারস্পরিক বুঝাপড়ার মাধ্যমে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সকলের অভিপ্রায় বা ইচ্ছার ভিত্তিতে একটি সাধারণ শক্তিকে মেনে নেওয়ার এবং সে শক্তির কাছে নিজেদের অধিকার সমর্পণ করে শাস্তি ও নিরাপত্তাময় জীবনের নিশ্চয়তা লাভের অভিপ্রায় বা প্রচেষ্টাই হলো এ চুক্তি।
লক-এর রাষ্ট্রদর্শন সম্বন্ধে জানতে ক্লিক করুন:
জন লকের রাষ্ট্রদর্শন -OnlineRedingRoom (onlinereadingroombd.com)
জন লকের সামাজিক চুক্তি মতবাদ: রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত সামাজিক চুক্তি মতবাদের অন্যতম প্রবক্তা’ হলেন আধুনিক গণতন্ত্রের জনক জন লক। ইংরেজ এ চিন্তানায়কের রচনাবলীর মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হলোঃ ÒTwo Treatises on Civil Government Ó এ গ্রন্থের অন্যতম আলোচ্য বিষয়বস্তু হচ্ছে সামাজিক চুক্তি মতবাদ। হবসের ন্যায় জন লকও বিশ্বাস করেন, রাষ্ট্রপূর্বে মানুষের প্রকৃতির রাজ্যে বসবাস করতো। তবে লকের মতে, প্রকৃতির রাজ্য ছিল শান্তি, সহযোগিতা ও সম্প্রীতির এক সুখময় স্থান। যেহেতু মানুষ শান্তিপ্রিয় ও যুক্তিবাদী ছিল এবং প্রাকৃতিক আইনের দ্বারা পরিচালিত হতো সেহেতু প্রকৃতির রাজ্য ছিল শুভেচ্ছা ও প্রতিরক্ষার রাজ্য। কিন্তু এসব সুবিধা সত্ত্বেও কতকগুলো বাস্তব অসুবিধা ছিল যার ফলে প্রকৃতির রাজ্যের স্বাচ্ছন্দ্য ব্যাহত হয়ে পড়েছিল। এগুলো হলো- পক্ষপাতদুষ্ট বিচার, আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব এবং পরস্পরবিরোধী আইন ও সিদ্ধান্ত।
রুশোর সামাজিক চুক্তি মতবাদ: ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম পুরোধা জ্যাঁ জ্যাকুয়েস রুশো তার ÔSocial Contract’ নামক গ্রন্থে রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত সামাজিক চুক্তি মতবাদটি আলোচনা করেছেন। হব্স ও লকের ন্যায় রুশোও বিশ্বাস করেন, যে রাষ্ট্র সৃষ্টি হবার আগে মানুষ প্রকৃতির রাজ্যে বসবাস করতো। তবে তার মতে, প্রকৃতির রাজ্য ছিল স্বর্গতুল্য। সেখানে মানুষের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব সংঘাত ছিল না। মানুষ সুখে শান্তিতে জীবন অতিবাহিত করতো। মানুষ ছিল সহজ, সরল ও শান্তিপ্রিয়। প্রত্যেকই ভোগ করতো অবাধ স্বাধীনতা। কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে মানুষের মধ্যে স্বার্থপরতার জন্ম নেয়। মানুষ দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। ফলে কালক্রমে প্রকৃতির রাজ্য অশান্তিতে ভরে উঠে। আর এ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই মানুষ পারস্পরিক চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠন করে। এ চুক্তির মাধ্যমে মানুষ প্রকৃতির রাজ্যে যেসব অধিকার ভোগ করতো সেগুলো হয় পরিত্যাগ করে নয়ত হস্তান্তর করে। প্রতিটি ব্যক্তি নিজেকে শাসন করার অধিকার চুক্তির ফলের গঠিত ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে সরকারের হাতে অপর্ণ করে। এখানে শর্ত হলো অন্যান্য ব্যক্তিরা এভাবে তাদের অধিকার একই শাসন কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেবে। সকল ইচ্ছা একটি মাত্র ইচ্ছায় এবং বিভিন্ন সত্তা একটি মাত্র সত্তায় পরিণত হবে। একেই বলা হয় কমনওয়েলথ। রুশোর মতে চুক্তির ফলে যে যৌথ সত্তার উদ্ভব তাই সাধারণ ইচ্ছা।
সামাজিক চুক্তি মতবাদের সমালোচনা: রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত সামাজিক চুক্তি মতবাদটির প্রভাব ব্যাপক। কিন্তু উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে এর গুরুত্ব হ্রাস পেতে থাকে। প্রকৃতপ্রস্তাবে আঠার শতক থেকেই এ মতবাদের বিরুদ্ধে সমালোচনা শুরু হয়। চুক্তি মতবাদের সমালোচকদের মধ্যে হিউম, হেনরি মেইন, বার্ক, বেন্থাম, পোলক প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সামাজিক চুক্তি মতবাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত বিভিন্ন অভিযোগ নিম্নরূপঃ
১. অযৌক্তিকঃ সামাজিক চুক্তি মতবাদের প্রবক্তাদের মতানুসারে প্রাক- রাষ্ট্রীয় প্রাকৃতিক অবস্থার অধিবাসীরা চুক্তির মাধ্যমেই রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে। রাষ্ট্র সৃষ্টির আগে চুক্তি সম্পাদানের কথা অযৌক্তিক।
২. অনৈতিহাসিকঃ রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত সামাজিক চুক্তি মতবাদের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ হলো, মতবাদটির কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। রুশোর ÔSocial Contract’ প্রকাশিত হওয়ার আগেই ইংরেজ দার্শনিক হিউম মন্তব্য করেছেন, চুক্তিবাদ অনৈতিহাসিক, মানবসভ্যতার সমগ্র ইতিহাস অনুসন্ধান করলেও এ রকম কোনো চুক্তির উদাহরণ পাওয়া যায় না।
৩. অবিশ্বাস্য মতবাদঃ সামাজিক চুক্তি মতবাদটি অবিশ্বাস্য। কার প্রাকৃতিক অবস্থায় আদিম মানুষের রাষ্ট্র সম্বন্ধে কোনো ধারণা ছিল না। সুতরাং তাদের পক্ষে রাষ্ট্রের উপযোগিতা উপলদ্ধি করাও সম্ভব ছিল না।
৪. প্রাকৃতিক আইন ও অধিকারের ভ্রান্ত ধারণাঃ সামাজিক চুক্তি মতবাদে প্রাকৃতিক আইন হিসেবে যে কথা বলা হয়েছে সঠিক বিচারে তা আইন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বে প্রাকৃতিক অবস্থায় প্রকৃত কোনো আইনের অস্তিত্ব অসম্ভব।
৫. রাষ্ট্র ও ব্যক্তির সম্পর্কের ব্যাপারে ভ্রান্ত ধারণাঃ সামাজিক চুক্তি মতবাদ রাষ্ট্রকে একটি অংশীদারি কারবারের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। কিন্তু রাষ্ট্র এবং অংশীদারি কারবার কোনোক্রমে সমপর্যায়ের সংগঠন নয়। অংশীদারি কারবারের সাথে অংশীদারদের সম্পর্কের দিক থেকে রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকদের সম্পর্ক অনেক বেশি দৃঢ় এবং অবিচ্ছেদ্য।
৬. অযৌক্তিক ও অবাস্তব মতবাদঃ সামাজিকবিহর্ভূত ব্যক্তির স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবনযাপনের কথা কল্পনা করে সামাজিক চুক্তি মতবাদ অযৌক্তিক ও অবাস্তব মতবাদ বলে সমালোচিত হয়েছে।
উপসংহার: উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, রাষ্ট্র উৎপত্তির ব্যাপারে সামাজিক চুক্তি মতবাদটি একটি স্থায়ী সম্পদ। সময়ের বিবর্তনের এ মতবাদটি বহুবিধ সামলোচনার সম্মুখীন হলেও এর বাস্তব উপযোগিতাকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। মতবাদটির ঐতিহাসিক ভিত্তি ও বৈজ্ঞানিক মূল্য দুর্বল হলেও পরবর্তী চিন্তানায়কদের উপর এ প্রভাব ব্যাপক।
অনলাইন রিডিং রুম শিক্ষক প্যানেল
টমাস হবসের সার্বভৌমতত্ত্ব সম্বন্ধে জানতে নিচের লিং-এ ক্লিক করুন:
টমাস হবসের সার্বভৌম তত্ত্ব -OnlineRedingRoom (onlinereadingroombd.com)
+88 01713 211 910