
জন লকের রাষ্ট্রদর্শন
প্রশ্ন: জন লকের রাষ্ট্রদর্শন আলোচনা কর। তাকে সংসদীয় গণতন্ত্রের জনক বলা হয় কেন?
অথবা, আধুনিক রাষ্ট্রন্তায় জন লকের সঠিক অবস্থান নির্ধারণ কর। অথবা, রাষ্ট্রদর্শনে জন লকের অবদান মূল্যায়ন কর।
উত্তর: ভূমিকা: ইংরেজ দার্শনিক জন লক সতের শতকের রাজনৈতিক চিন্তাধারায় সমসাময়িক দার্শনিকদের মধ্যে বিশেষ স্থান দখল করে আছেন। তাকে মধ্যযুগের এমনকি সর্বকালের অন্যতম বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানীররূপে অভিহিত করা হয়। তার পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্বের ধারণা রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে নব দিগন্তের সূচনা করে।
রাষ্ট্রদর্শনে জন লকের অবদান: রাষ্ট্রদর্শনে জন লক যে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন সেগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১. প্রাকৃতিক অধিকার তত্ত্বের প্রবক্তা: জন লককে প্রাকৃতিক অধিকার তত্ত্বের প্রবক্তা হিসেবে অভিহিত করা হয়। প্রাকৃতিক অধিকার তত্ত্বের মাধ্যমে তিনি মানুষের জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকারকে মানুষের পবিত্রতম অধিকার বলে ঘোষণা করে মানব জাতির অশেষ কল্যাণ সাধন করেছেন।
এরিস্টটলের বিপ্লব সম্বন্ধে জানতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন:
২. ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রবক্তা: জন জককে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রবক্তা হিসেবে অভিহিত করা হয়। ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকারকে সংরক্ষণ ও নিরাপদ করার জন্য তিনি সরকারের ক্ষমতা পৃথক পৃথক তিনটি বিভাগের উপর ন্যস্ত করার কথা উল্লেখ করেছেন এবং এক বিভাগ কর্তৃক অন্য বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ না করার কথা বলেছেন।
৩. সম্পত্তি তত্ত্বের প্রবক্তা: জন লকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো তার সম্পত্তি সংক্রান্ত মতবাদ। সম্পত্তির অধিকারকে তিনি মানুষের পবিত্রতম প্রাকৃতিক অধিকার বলে বর্ণনা করেছেন।
৪. ধর্মীয় সহনশীলতার নীতি: রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে লকের ধর্মীয় সহনশীলতা একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তিনি ধর্মীয় সহনশীলতার নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। ধর্মীয় সহনশীলতার ব্যাপারে তিনি সম্পূর্ণ নিরাসক্ত দৃষ্টিভঙ্গি গঠন করতে না পারলেও তার এ তত্ত্বের দ্বারা ইউরোপ বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছে।
৫. দায়িত্বশীল সরকারের প্রবক্তা: জন লক দায়িত্বশীল সরকার ব্যবস্থার সমর্থক ছিলেন। তিনি সরকারকে জনগণের স্বার্থ ও অধিকারের জিম্মাদার হিসেবে কল্পনা করেছেন।
৬. নিয়মতান্ত্রিক গণতন্ত্রের প্রবক্তা: জন লক ছিলেন নিয়মতান্ত্রিক গণতন্ত্রের প্রবক্তা। তিনি সরকারকে শাসিতের সম্মতি ও সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসনের উপর প্রতিষ্ঠিত করে নিয়মতান্ত্রিক গণতন্ত্রকে অত্যন্ত মজবুত ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়েছেন।
৭. সম্মতি তত্ত্বের প্রবক্তা: জন লকের রাষ্ট্রদর্শনের সম্মতি একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব। তার মতে, জনগণের সম্মতি হলো রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি। তিনি বিশ্বাস করেন যে, কোনো শাসকের বৈধতার প্রধান ভিত্তি হচ্ছে শাসিতের সম্মতি।
৮. সাংবিধানিক সরকারের জনক: জন লককে সাংবিধানিক সরকারে জনক হিসেবে অভিহিত করা হয়। চরম সার্বভৌমিকতার পরিবর্তে শাসনতান্ত্রিকতাকে তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতকে তিনি শাসনতান্ত্রিকতার মানদণ্ড হিসেবে ধরেছেন। জন লকের পূর্বে কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর এভাবে জোর দিয়ে বলেন নি যে, জনগণের সম্মতি ব্যতীত সরকারের বৈধতা মূল্যহীন।
৯. গণসম্মতির উপর গুরুত্ব প্রদান: জন লক উদাত্ত কন্ঠে ঘোষণা করেন, যে, সরকারের ক্ষমতার মূলভিত্তি হচ্ছে জনসমর্থন ও গণসম্মতি।
১০. সরকারের দায়িত্বশীলতা: লক তার রাষ্ট্রদর্শনে বলেন, সরকারর যে জনগোষ্ঠীকে শাসন করে সে জনগোষ্ঠীর নিকট সরকার দায়ী থাকবে। তার এ সরকারের দায়িত্বশীলতার নীতি সর্বজনস্বীকৃত।
১১. সরকারের শ্রেণীবিভাগ: লক জনগণ বা সম্প্রদায়কে ক্ষমতার চূড়ান্ত উৎস হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি সরকারকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করেছেন। এগুলো হলো- (ক) পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র, (খ) কতিপয় তন্ত্র ও (গ) রাজতন্ত্র।
তাছাড়া জন লক ছিলেন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদেও পথিকৃৎ, গণসার্বভৌমত্বেও স্রষ্টা, শ্রমতত্ত্বেও উদ্ভাবক, উদারনীতিবাদেও প্রবক্তা।
সংসদীয় গণতন্ত্রেরে জনক হিসেবে লক: জন লকের রাষ্ট্রচিন্তার মূল লক্ষ্য ছিল স্বৈরতন্ত্রের প্রতিরোধ করা এবং জনগণের যথার্থ স্বাধীনতা ও কর্তৃত্বকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা। তার রাষ্ট্রদর্শনের মূল কথাই ছিল সরকারের দায়িত্বশীলতা এবং সংসদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা। লকের মতে, সরকারের তিনটি বিভাগের মধ্যে আইন বিভাগই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ। কেননা, এ বিভাগ রাষ্ট্রের বা স¤প্রদায়ের যথার্থ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে। তাই আইন বিভাগের সর্বোচ্চা ক্ষমতার নিকট সরকারের অন্যান্য বিভাগকে অধস্ততন হতেই হবে। লকের মতে, আইনসভার কাজ হচ্ছে জনগণের জীবন, স্বাধীনতার এবং সম্পত্তি সংরক্ষণের জন্য উপযোগী আইন প্রণয়ন ও সংরক্ষণ করা।
সুতরাং বলা যায়, জন লক আইন বিভাগের শ্রেষ্ঠত্বের নীতি প্রচার করে এবং আইন বিভাগের কাছে নির্বাহী বিভাগকে দায়বদ্ধ করে আধুনিক সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রথম পথিকৃতের গৌরব অর্জন করেছেন। তার নিয়মতান্ত্রিক সরকারের ধারণা, সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন ও জনগণের তথা পার্লামেন্টারি সার্বভৌমত্বের ধারণা গণতন্ত্রের পথকে প্রশস্ত করেছে। আর এ কারণেই তাকে সংসদীয় গণতন্ত্রেও জনক বলেছেন।
সমালোচনা: জন লকের রাষ্ট্রদর্শন একেবারে ত্রুটিমুক্ত নয়। তার রাষ্ট্রদর্শনের ত্রুটিসমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ
১. আইনগত সার্বভৌমত্ব উপেক্ষিত: জন লক জনগণের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করেছেন, কিন্তু আইনগত সার্বভৌমত্ব উপেক্ষা করেছেন।
২. সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন: সমালোচকদের মতে, লকের সম্মতি তত্ত্ব সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন ও অত্যচারকে সমর্থন করে। সংখ্যালঘিষ্ঠের অধিকার রক্ষায় বাস্তব ব্যবস্থা লকের এ তত্ত্বে নেই।
৩. অসংগত ধারণা: লকের জ্ঞানতত্ত্ব ও সম্পত্তি তত্ত্বের ধারণা অসংগতিপূর্ণ। কেননা, তিনি যে প্রাকৃতিক অধিকারের কথা বলেছেন তা সহজাত ধারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।
৪. আংশিক সার্বভৌম: সার্বভৌম তত্ত্বে জন লক আইনগত সার্বভৌমত্বকে উপেক্ষা করেছেন। তিনি শুধু জনগণের সার্বভৌমত্বের কথাই বলেছেন। কাজেই এটি আংশিক সার্বভৌম তত্ত্ব।
৫. সরকারের উৎপত্তি: সরকারের উৎপত্তি সম্পর্কে লক বিস্তারিতভাবে কিছু আলোচনা করেন নি। তিনি কেবল উল্লেখ করেছেন, যারা সংঘবদ্ধ হয়ে সমাজ স্থাপন করল তারাই একপা সরকারের অধীনে এসে গেল।
৬. বর্তমানে অচল: জন লক সামাজিক চুক্তির যে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন বর্তমানে তা প্রযোজ্য নয়।
তাছাড়া জন লকের মতবাদকে অনেকে ভ্রান্ত মতবাদ, বুর্জোয়া অর্থনীতির সহায়ক বলে মন্তব্য করেছে।
উপসংহার: উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় লকের অবস্থান স্থায়ী এবং সুদৃঢ়। কেননা মানুষের চিন্তা ও প্রতিষ্ঠানের উপর অন্য কোনো দার্শনিক লকের মতো এত গভীর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন নি।
রুশোর সাধারণ ইচ্ছা মতবাদ সম্বন্ধে জানতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন:
রুশোর সাধারণ ইচ্ছা মতবাদ -OnlineRedingRoom (onlinereadingroombd.com)
অনলাইন রিডিং রুম শিক্ষক প্যানেল
+88 01713 211 910