
১৯৭০ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
প্রশ্ন : ১৯৭০ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য আলোচনা কর।
উত্তর : অখণ্ড পাকিস্তানের ইতিহাসে ১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল তাৎপর্যপূর্ণ ও গুরুত্ববহ। কেননা, এই নির্বাচন পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসের দীর্ঘ চব্বিশ বছর সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রথম ও শেষ নির্বাচন। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল জনসমর্থন অর্জন করে। তাছাড়া প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। আওয়ামী লীগের এ বিপুল বিজয় প্রমাণ করে যে, পূর্ববাংলা মানুষ একটি জাতি হিসেবে ঐক্যবদ্ধ এবং ৬ দফার ভিত্তিতে তারা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলে শুধু বাঙালিদেও জাতীয় আশা আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটে নি, বরং এর দ্বারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানার নেতৃত্ব দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি রাষ্ট্রসমূহ ও সরকারের কাছ থেকে যে সাহায্য সহযোগিতা আসে তা ছিল প্রকৃত পক্ষে এই নির্বাচনেরই ফসল। এই নির্বাচনের মাধ্যমেই তথাকথিত পাকিস্তানের জাতিসত্তা দ্বিখণ্ডিত হয় এবং ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতিসত্তার উন্মেষ ঘটে। আর এই জাতীয়তাবোধই ১৯৭১ সালে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। নিচে সূত্রাকারে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরা হলো:
Introduction to Political Theory, আইনের সংজ্ঞা দাও। আইনের উৎসসমূহ সম্বন্ধে জানতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন:
আইনের সংজ্ঞা দাও। আইনের উৎসসমূহ -OnlineRedingRoom (onlinereadingroombd.com)
১. বাঙালি জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি: ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার বীজ অঙ্কুরিত হয়। অতঃপর ৫৪’র নির্বাচন, ৬৬’র ছয়দফা, ৬৯’এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তা পূর্ণতা পায়। সর্বশেষে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের রায়ের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক ভিত্তি লাভ করে। এই নির্বাচন বৈশ্বিক দৃষ্টি আকর্ষণেও সক্ষম হয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় প্রকৃত পক্ষে বাঙালি জাতীয়তাবাদেরই বিজয়।
২. পূর্ব পাকিস্তানের বিলুপ্তি: ১৯৭০ সালের নির্বাচন আধুনিক গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক বিস্ময়কর ঘটনা। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন লাভ করে, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে কোনো আসনই পায় নি। অপর দিকে পিপলস পার্টিং পশ্চিম পাকিস্তানে সর্বাধিক আসন লাভ করে, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে একটি আসনও পায় নি। এতে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, পাকিস্তানের এক অংশের জনগণ অন্য অংশকে সমর্থন করে না। তাছাড়া এতে আরো স্পষ্ট হয় যে, অভয় অংশের জনগণ বিভক্তিকরণ চায়। তাই ১৯৭০ সালের নির্বাচনকে অনেকই পূর্ব পাকিস্তানের বিলুপ্তি বার্তাবাহক হিসেবে গণ করেন।
৩. ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান: এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তথা ছয় দফার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞপন করে। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শক্তি বিরুদ্ধে স্বাধিকারকামী বাঙালি জনগণের নিশ্চিত রায়। তাই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালি জনগণ মুক্তিচেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়।
৪. জতীয় ঐক্যের প্রকাশ: ১৯৭০ সালের নির্বাচন প্রমাণ করে যে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের ঐক্যের কোনো ভিত্তি নেই। পাকিস্তানের দুই অংশের জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা ও মানসিকতা ভিন্নমুখী। এই নির্বাচন আরো প্রমাণ করে যে, জাতীয় বিভিন্ন বিষয়ে সমন্বয় সাধন করা অত্যন্ত কঠিন বিষয়। সুতরাং প্রত্যেকের স্ব-স্ব স্বাধীনতাই সংকট নিরসনের এক মাত্র উপায়।
৫. আত্মশক্তি বৃদ্ধি: ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ের ফলে বাঙালি জাতীয়তাবোধের চেতনায় উল্লসিত হয় এবং তারা আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে ওঠে। এ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বাঙালি জাতি প্রথমবারের মতো নিজেদের সুসংহত শক্তি হিসেবে ভাবতে শুরু করে।
৬. পাকিস্তানে জাতীয় রাজনৈতিক দলের অভাব: ১৯৭০ সালে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে ১৬৭টি আসন লাভ করে কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে একটি আসনও পায় নি। বিপরীক্রমে ভুট্টোর পিপলস পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পূর্ব পাকিস্তানে ছিল আসন শূন্য। ফলে পাকিস্তানের উভয় অংশে নেতৃত্ব দেয়ার রাজনৈতিক দলের অভাব তীব্রভাবে অনুভূত হয়।
৭. সংগ্রামী চেতনা জাগ্রত হয়: ১৯৭০ সালে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাঙালিদের মধ্যে সংগ্রাম চেতনা জাগ্রত হয়। তারা পাকিস্তানি শাসন শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। যার ফলে পূর্ব বাংলার আপামর জনগণ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
৮. পশ্চিম পাকিস্তানের কর্তৃত্ব নাশ : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ববাংলার জনগণ আওয়ামী লীগকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করে। এতে পূর্ব পাকিস্তানের উপর কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ব কমতে থাকে। অসহযোগ আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগই পূর্ব বাংলা শাসন ক্ষমতার বৈধ প্রতিনিধি হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগের ইচ্ছাতেই পূর্ব বাংলা পরিচালিত হতে থাকে।
৯. আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবের জাতীয় ও আন্তজার্তিক স্বীকৃতি: ১৯৭০ সালে নির্বাচনের ফলে আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তানে সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করে।
উল্লিখিত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাঙালির সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণিত হয় এবং পাকিস্তানের শোষণমূলক মনোভাব উন্মোচিত হয়। এই নির্বাচনে জয় লাভ করে বাঙালি বিপুল উৎসাহে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অবশেষে অবিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত উপেক্ষা করে একটি স্বাধীন সার্বভৌম জাতি হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে নিজেদের অবস্থানকে সুদৃঢ় করে। তাই বলা যায়, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়েই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের পথ প্রশস্ত হয়।
রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত সামাজিক চুক্তি মতবাদ সম্বন্ধে জানতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন:
রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত সামাজিক চুক্তি মতবাদ -OnlineRedingRoom (onlinereadingroombd.com)
অনলাইন রিডিং রুম শিক্ষক প্যানেল
+88 01713 211 910